সিলেট অফিস: মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন ও ইলমুল কুরআনের প্রচার-প্রসারে জীবন উৎসর্গ করেছেন সিলেট জেলার সদর উপজেলার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও দ্বীনের খাদিম মুহতামিম মাষ্টার আব্দুল করিম সাহেব। একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক, সমাজসেবক, তাসাউফপ্রেমী ও কিরাতের খাদিম হিসেবে তাঁর জীবন ছিল আল্লাহ ও রাসূল (সা.)-এর প্রেমে অনুপ্রাণিত। তিনি শুধু একজন শিক্ষকই নন, বরং একজন নির্মাতা—যিনি সমাজে হাফিজ, ক্বারী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও আদর্শ নাগরিক গড়ে তুলেছেন।
জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়
মাষ্টার আব্দুল করিম সাহেব ১৯৫২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সিলেট সদর উপজেলার ৭নং মোগলগাঁও ইউনিয়নের লালারগাঁও গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম তালুকদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন মরহুম মোঃ আব্দুর রশিদ এবং মাতা ছিলেন নেককার ও ফরেজগার মহিলা মরহুমা সূর্যবান নেছা।
তিন ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন কনিষ্ঠ সন্তান। ছোটবেলা থেকেই তিনি সৎ, সত্যবাদী ও অধ্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মায়ের দোয়ার বরকতে তিনি দ্বীনের খেদমতে আত্মনিয়োগ করতে পেরেছেন বলে তিনি সবসময় উল্লেখ করতেন।
শিক্ষাজীবন
প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন লালারগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে কুচাই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ১৯৬৮ সালে ইছরাব আলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি পাস করেন।
উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন মদন মোহন কলেজে এবং ১৯৭০ সালে এইচ.এস.সি ও ১৯৭২ সালে ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।
১৯৮১ সালে পি.টি.আই স্কাউট প্রশিক্ষণ এবং ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল থেকে ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করে তিনি শিক্ষাজীবনের একটি দৃঢ় ভিত্তি রচনা করেন
কর্মজীবন
১৯৭৩ সালে শিক্ষকতা পেশায় যোগ দিয়ে তিনি শিক্ষা সেবার মাধ্যমে সমাজ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
দীর্ঘ ৩৬ বছরের সফল শিক্ষকতা জীবনের পর ২০০৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি লালারগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
তিনি সিলেট সদর উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
দারুল কেরাতের খেদমত
১৯৮১ সালে তিনি দারুল কেরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্টে ভর্তি হয়ে নিয়মিত অধ্যয়ন করেন এবং ১৯৮৫ সালে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন।
এরপর থেকে আজীবন তিনি কিরাতের খেদমতে নিয়োজিত থাকেন। তিনি দীর্ঘ ৪৪ বছর দারুল কেরাত ট্রাস্টের অধীনে খাদিম হিসেবে কাজ করেছেন এবং লালারগাঁও হাবিবিয়া হাফিজিয়া দাখিল মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা নাযিম ছিলেন।
এছাড়া তিনি লতিফিয়া কারী সোসাইটি, সিলেট সদর উপজেলার সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন (২০২৩ সাল পর্যন্ত)।
মাদ্রাসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা
তিনি লালারগাঁও হাবিবিয়া হাফিজিয়া দাখিল মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম।
একটি ছোট্ট মক্তব থেকে তাঁর উদ্যোগে শুরু হওয়া প্রতিষ্ঠানটি আজ এলাকার অন্যতম দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৯৮৮ সালে আল্লামা নিজাম উদ্দিন চৌধুরী (রহ.)-এর দোয়ার মাধ্যমে বর্তমান স্থানে মাদ্রাসার ভিত্তি স্থাপিত হয়।
মাদ্রাসার স্বীকৃতি ও এমপিওভুক্তির জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তাঁর নেতৃত্বেই মাদ্রাসা পরবর্তীতে দাখিল স্তরের স্বীকৃতি লাভ করে।
খানকা ও তাসাউফ
১৯৯৪ সাল থেকে প্রতি বৃহস্পতিবার লালারগাঁও মাদ্রাসায় সাপ্তাহিক সফিনা ও মিলাদ মাহফিলের সূচনা হয়। মাওলানা রহমত উল্লাহ সৎপুরী (রহ.)-এর অনুমতিক্রমে তিনি যিকর পরিচালনা করতেন এবং ছাত্রদের কলবীয় যিকরের তালিম দিতেন।
তাসাউফে তাঁর প্রথম শিক্ষাগুরু ছিলেন আল্লামা হাবিবুর রহমান মুহাদ্দিস রারাই (রহ.) এবং পরবর্তীতে তিনি আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.)-এর কাছ থেকে ইজাযত ও খেলাফত লাভ করেন (১৯৯৫ সালে)।
হিযবুল বাহার ওযিফার চিল্লা
তিনি আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.)-এর তত্ত্বাবধানে একাধিকবার হিযবুল বাহার ওযিফার চিল্লায় অংশগ্রহণ করেন। তাঁর সঙ্গে সেইসব চিল্লায় ছিলেন বহু বিশিষ্ট আলেম ও মাশায়েখ।
ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.) এবং রারাই মুহাদ্দিস ছাহেব (রহ.) উভয়েই তাঁকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন।
মসজিদ, স্কুল ও সমাজসেবা
তিনি লালারগাঁও জামে মসজিদের মুতাওয়াল্লী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং মসজিদের নতুন ভবন নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
এছাড়া তিনি পশ্চিম সদর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিটি ধাপে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
তিনি সৎপুর ও ফতেহপুর কামিল মাদ্রাসাসহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটিতে দায়িত্ব পালন করে শিক্ষা বিস্তারে বিশেষ অবদান রাখেন।
হজ্জ ও উমরাহ
২০১২ সালে তিনি আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলীর (বড় ছাহেব কিবলাহ) সঙ্গে পবিত্র হজ্জ পালন করেন এবং ২০১৮ সালে উমরাহ আদায় করেন।
পারিবারিক জীবন
১৯৭৯ সালে তিনি বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী মরহুম মাষ্টার এখলাছুর রহমান সাহেবের কন্যার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
তাঁর পরিবারে তিন পুত্র ও দুই কন্যা রয়েছে। সন্তানরা জেনারেল ও দ্বীনি উভয় শিক্ষায় শিক্ষিত। বর্তমানে একজন পুত্র যুক্তরাষ্ট্রে ও অন্যজন ফ্রান্সে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।
অসুস্থতা ও শেষ জীবন
২০২৩ সালের রমজানের প্রথম দিনে মাদ্রাসার দারুল কেরাত সেন্টারের কাজে ব্যস্ত অবস্থায় তিনি ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। তারপর থেকে তিনি শয্যাশায়ী।
তাঁকে দেখতে আলেম, মুহতামিম, ফুলতলী পরিবারের সদস্য এবং অসংখ্য প্রাক্তন ছাত্র-শিক্ষার্থী ছুটে আসেন।
উপসংহার
মুহতামিম মাষ্টার আব্দুল করিম সাহেব একজন অনন্য শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবক ও আলেমদের শ্রদ্ধার পাত্র।
তিনি ছিলেন এমন এক আলোকবর্তিকা, যার আলোয় আলোকিত হয়েছে অসংখ্য প্রাণ, জেগে উঠেছে একটি প্রজন্ম।
তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় ইলম, আমল ও তাসাউফের সমন্বয়ে দীপ্তিমান।
আল্লাহ তায়ালা তাঁকে সুস্থতা, দীর্ঘায়ু ও দ্বীনের খেদমতে আরও সুযোগ দান করুন।
আল্লাহুম্মা আমিন।
নিজস্ব সংবাদ : 














